Logo
Logo
×

প্রযুক্তি

সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তি: বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

Icon

আইটি ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫ মে ২০২৫, ১৬:৫৬

সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তি: বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?

তথ্যপ্রযুক্তি-নির্ভর বিশ্বে ‘ই-গভর্নেন্স’ এখন আর কোনো বিলাসিতা নয়, বরং একটি অত্যাবশ্যকীয় সেবার রূপ নিয়েছে। উন্নত দেশগুলো যেখানে এই পরিবর্তনের গতিকে শতভাগ ব্যবহার করে এগিয়ে চলেছে, সেখানে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশও পিছিয়ে নেই। তবে প্রশ্ন হলো, যখন আমরা বাংলাদেশের ই-গভর্নেন্সের অগ্রগতির সঙ্গে এস্তোনিয়া বা সিঙ্গাপুরের মতো দেশের তুলনা করি, সেটা কি যথার্থ? নাকি এই তুলনাগুলো বাস্তবতাবিবর্জিত? এই প্রশ্নের গভীরে গেলে বোঝা যাবে, তুলনাটি অমূলক নয়; বরং এর মাধ্যমে আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতা, সম্ভাবনা এবং করণীয়গুলো আরও স্পষ্ট করে দেখতে পাই।

এস্তোনিয়া এবং সিঙ্গাপুর — দুইটি ভিন্ন ভৌগলিক অবস্থান, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির দেশ হলেও এক জায়গায় তাদের মিল রয়েছে, আর তা হলো প্রযুক্তিকে জাতীয় উন্নয়নের কৌশল হিসেবে গ্রহণ করা। এস্তোনিয়া নব্বইয়ের দশকে স্বাধীন হওয়ার পরই ইন্টারনেটকে নাগরিক অধিকারে পরিণত করে, আর সিঙ্গাপুর আশির দশকের সংকট কাটিয়ে উঠতে তথ্যপ্রযুক্তিকেই প্রধান হাতিয়ার বানায়। তারা রাষ্ট্রীয় নীতিমালার কেন্দ্রবিন্দুতে প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করে। এই উদ্যোগগুলো ছিল সুপরিকল্পিত, দীর্ঘমেয়াদী এবং সর্বস্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য নিবেদিত।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখলে বোঝা যায়, আমাদের যাত্রাপথ ছিল ভিন্নতর। আমরা একটি বিশাল জনগোষ্ঠী, জটিল আমলাতান্ত্রিক কাঠামো এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ভেতর দিয়ে অগ্রসর হয়েছি। এখানে প্রযুক্তি-নির্ভর প্রশাসনের চিন্তাটি দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে সময় নিয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি নীতিমালা প্রণয়ন, ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপকল্প ঘোষণা এবং ‘মাইগভ’ প্ল্যাটফর্মের মতো উদ্যোগ সেই যাত্রার অঙ্গ। ফলে, তুলনা করাটা তখনই যৌক্তিক যখন আমরা তা প্রেক্ষাপট বুঝে করি।

এস্তোনিয়ার ‘এক্স রোড’ বা সিঙ্গাপুরের ‘ওয়ানস্টপ ই-সিটিজেন’ ব্যবস্থা যখন কার্যকর হয়, তখন তাদের জনসংখ্যা ছিল একেবারে সীমিত। এর বিপরীতে বাংলাদেশে বিপুল জনসংখ্যা, গ্রামীণ জনপদে বসবাস, অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। ইন্টারনেট অবকাঠামো তৈরি, নাগরিকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সরকারি দপ্তরগুলোতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা তৈরি করতে বাংলাদেশকে এক যুগান্তকারী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

বিশেষ করে ই-গভর্নেন্সের সুবিধা প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার চ্যালেঞ্জটা ছিল বিশাল। যেখানে এস্তোনিয়ায় বা সিঙ্গাপুরে সেবা সরবরাহের জন্য অপেক্ষাকৃত কম এলাকা এবং কম জনগোষ্ঠীর ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন ছিল, সেখানে বাংলাদেশে প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত ডিজিটাল সেবা নিশ্চিত করতে হয়েছে। ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার স্থাপন, মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তার এবং ব্রডব্যান্ড কানেক্টিভিটি বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিত বিনিয়োগ বাংলাদেশের এই অগ্রযাত্রার সাক্ষী।

কিন্তু বিষয়টি এখানে শেষ হয় না। বাংলাদেশের তুলনায় সিঙ্গাপুর ও এস্তোনিয়ার আরেকটি সুবিধা ছিল নাগরিক মনোভাব। প্রযুক্তি গ্রহণ এবং ব্যবহারে তাদের সমাজ ছিল অপেক্ষাকৃত উন্মুক্ত। বাংলাদেশে এই মনোভাব গড়ে তুলতে সময় লেগেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা নিয়ে সংশয়, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা সংক্রান্ত শঙ্কা এবং নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারে দ্বিধা অনেকাংশেই আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল। একে দূর করতে গণসচেতনতা কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ এবং সময়োপযোগী আইনী কাঠামো গড়ে তুলতে হয়েছে।

সিঙ্গাপুরের উদাহরণ যদি ধরা হয়, দেখা যায় তারা সরকারি সেবায় উদ্ভাবনী সংস্কৃতি তৈরির জন্য সরকারি কর্মচারীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়েছে। বাংলাদেশও এখন সেই পথেই হাঁটছে। ‘এপিএ’ (বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তি) এবং বিভিন্ন সেবার ডিজিটালাইজেশন প্রকল্পের আওতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। যদিও এখানে গতি বাড়ানো প্রয়োজন, তবে অগ্রগতি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

অন্যদিকে, এস্তোনিয়া ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সরকারি ডেটা সুরক্ষা নিশ্চিত করেছে। বাংলাদেশও এখন জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থাপনা, ভূমি নিবন্ধন কিংবা ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশনের মতো ক্ষেত্রে নিরাপদ ডেটা ব্যবস্থাপনার দিকে এগোচ্ছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ ভিশনের অধীনে আজ জাতীয় পর্যায়ে তথ্য সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার ব্যাপারে একটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসে, তুলনা করে আমরা কী শিখতে পারি? প্রথমত, বুঝতে পারি যে প্রযুক্তি ব্যবহারের জন্য কেবল প্রযুক্তি থাকা যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, জনসচেতনতা এবং সাংগঠনিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। দ্বিতীয়ত, বুঝি যে প্রতিটি দেশের বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ায় সমন্বিত পরিকল্পনার গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন এস্তোনিয়া বা সিঙ্গাপুর এক ধরনের বাস্তবতায় যে মডেল সফল করেছে, তা হয়তো হুবহু বাংলাদেশে প্রয়োগযোগ্য নয়। কিন্তু মূলনীতি বা দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে নিজেদের উপযোগে মানিয়ে নেওয়া সম্ভব।

তুলনার প্রয়োজনীয়তা এখানেই: বাস্তবতা বোঝা এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নেওয়া। অমূলক হত যদি আমরা ভাবতাম, “ওরা পারে কারণ ওরা আলাদা, আমরা পারবো না।” পরিবর্তে তুলনামূলক বিশ্লেষণ আমাদের অনুপ্রাণিত করে, সীমাবদ্ধতা শনাক্ত করতে সাহায্য করে এবং লক্ষ্য নির্ধারণে সহায়ক হয়।

বিশ্বব্যাপী ই-গভর্নেন্স এখন আর নিছক সেবা প্রদানের বিষয় নয়, এটি জনগণের আস্থা অর্জন এবং প্রশাসনের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার মাধ্যম। এ দিক দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করেছে। যেমন, জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবস্থাপনার ডিজিটালাইজেশন, অনলাইন কর প্রদান ব্যবস্থা, ই-টেন্ডারিং এবং অনলাইন জন্মনিবন্ধন সেবা এখন সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে বাংলাদেশের ই-গভর্নেন্স ব্যবস্থার সক্ষমতা এক বাস্তব পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিল। সেই পরীক্ষায় বাংলাদেশ মোটামুটি সফল হয়েছে — কোটি কোটি মানুষকে অনলাইনে নিবন্ধন করে ভ্যাকসিন দেওয়া, এনআইডি যাচাই এবং বিভিন্ন প্রণোদনা কর্মসূচি পরিচালনা তার প্রমাণ।

তবে আত্মতুষ্টির কোনো অবকাশ আমাদের নেই। এখনও ডিজিটাল বিভাজন (ডিজিটাল ডিভাইড) পুরোপুরি দূর হয়নি। এখনো সেবার মান ও নাগরিকদের সন্তুষ্টির মধ্যে ব্যবধান রয়েছে। এসব জায়গায় আরও মনোযোগী হতে হবে। এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুর যেভাবে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে নিয়মিত উদ্ভাবন ও সংস্কার চালিয়ে যাচ্ছে, বাংলাদেশকেও ঠিক সেইভাবে পরিবর্তিত হতে হবে।

তুলনা আদতে নেতিবাচক কোনো বিষয়, বরং এটি খুলে দেয় সম্ভাবনার দুয়ার। এটি আমাদের নিজস্ব অগ্রগতি পরিমাপের মানদণ্ড তৈরি করে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুরের উদাহরণ থেকে আমরা শিখতে পারি পরিকল্পনা, নেতৃত্ব, এবং অবিচল প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে একটি জাতির ভাগ্য রচনা করা যায়। তাই বলতেই হয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ ধরনের তুলনা মূলকই — অমূলক নয়।


Logo

অনুসরণ করুন