
সারোয়ার তুষার ও নীলা ইস্রাফিল। ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) নেতা সারোয়ার তুষারের সঙ্গে একটি নারীকণ্ঠের ফোনালাপ সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তা ঘিরে শুরু হয় তুমুল আলোচনা। অনেকেই দাবি করেন, ফোনালাপে শোনা যাওয়া কণ্ঠটি এনসিপির এক নেত্রীর।
অবশেষে এনসিপির নীলা ইস্রাফিল নামে এক নেত্রী নিজেই স্বীকার করেছেন যে, ভাইরাল হওয়া অডিওর নারী কণ্ঠটি তার। বৃহস্পতিবার (১৯ জুন) নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে এক দীর্ঘ পোস্টে তিনি বিষয়টি খোলাসা করেন এবং ঘটনাপ্রবাহ বিস্তারিত তুলে ধরেন।
এদিকে, নীলার দেওয়া দীর্ঘ পোস্টের পর সারোয়ার তুষারও তার বক্তব্য নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে তুলে ধরেছেন। বাংলা১৮ পাঠকদের জন্য এনসিপির এই দুই নেতার বক্তব্য তুলে ধরা হলো:
নিজের পোস্টে নীলা ইস্রাফিল লিখেন, ‘আমার নাম নীলা ইস্রাফিল।
আমি এনসিপির সদস্যা হই বা না হই -
আমি একজন যোদ্ধা। ✊
আমি আমার শ্বশুরবাড়িতে লেক্সাসে চড়তাম। ২৬ জন কাজের লোক ছিল। আরাম আয়েশের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু খারাপ প্রস্তাব পাওয়ার পর আমার শ্বশুর প্রয়াত উপদেষ্টা সুফি চেহারার আড়ালে বিভৎস হাসান আরিফকেও আমি ছাড় দেই নাই।
আমার এথিক্সের সাথে যায় না বলে আমি পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রের সাথে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের সব চেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষটির অন্যায়কে প্রতিবাদ করেছি।
আমি জানি আমি যা বলেছি তা কেউ বিশ্বাস করবে না।
এটা অবিশ্বাস্য। আমি জানতাম, এত সুদর্শন, এত অভিজাত, এত সম্মানিত একটা মানুষকে অসম্মান করার অপরাধে সমাজে আমাকে রাস্তায় ছুঁড়ে ফেলে দেবে।
কিন্তু সেটা জেনেও আমি আমার প্রতি করা অবিচারের প্রতিকার চেয়ে গিয়েছি—অসংখ্য প্রলোভন দেওয়া সত্ত্বেও আপোষ করিনি। এর পরিণতিতে আমার নামে ১৯টি মামলা দেওয়া হয়, কোনো উকিল ওয়ান ইলেভেনের উপদেষ্টা, সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল হাসান আরিফের বিপক্ষে দাঁড়ায় নাই।
আমার ছোট মেয়ের জন্ম হয়েছে কারাগারে, আমি এখন পর্যন্ত আমার দুই মেয়েকে নিয়ে একসাথে ঘুমাতে পারিনি।
২০২০ সালে আমার পেটের বাচ্চাকে লাথি দিয়ে মেরে ফেলা হয়।
আমি তাও এখনো প্রয়াত উপদেষ্টা হাসান আরিফ, বাংলাদেশের বিচার বিভাগ, পুলিশ ও ডিবির সাথে লড়াই করে যাচ্ছি।
আমার কাছ থেকে আপনারা কীভাবে আশা করেন যে, তুষারের আমার সাথে এই আচরণের আমি প্রতিবাদ করব না?
গণ-অভ্যুত্থানে আমি সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছি। গণ-অভ্যুত্থানের সময় আন্দোলনে রাস্তায় নামার কারণে, হাসান আরিফ আমার বাচ্চা দুইটাকে রেখে আমাকে বাসা থেকে বের করে দেয়। তিনি আমাকে বলেন যে, আমার কারণে আওয়ামী লীগ বাসায় পৌঁছে যাবে।
এই সময়ে গণ-অভ্যুত্থানের সাথে গড়ে ওঠা, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের সাথে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারা আমার প্রতি করা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাড়ায়।
আমি সপ্রতিভ, কর্মোদ্যম ও সৃজনশীল মানুষ। ফলে আগস্টের পর থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন নেতা ও কর্মীর সাথে আমার আলাপ হত। তুষারের সাথে তখনই পরিচয় এবং এনসিপির জন্মের পূর্বেই তার সাথে সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক আলাপ হতো।
বিগত ডিসেম্বরে আমার প্রাক্তন স্বামী মুয়াজ আমাকে ঢাকা ক্লাবে সবার সামনে স্টেক নাইফ দিয়ে হত্যা চেষ্টার পর শহিদুল ভাই, সারা আপা, ফজিয়া করিম আন্টি সহ বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মীরা আমাকে নিরাপত্তার নিয়ে বিচলিত হয়ে যায়। সেজন্য মানবাধিকার কর্মী Rezaur Rahman Lenin আমাকে নেপালে পাঠিয়ে দেয়। নেপালে যাওয়ার পর থেকে তুষার প্রায়ই ফোন করতো ও তার আলাপের ধরন পাল্টাতে থাকে। সে আমাকে বিভিন্নভাবে অ্যাপ্রোচ করতে থাকে—
“তোমার ছবি দাও,”
“তোমার ঠোঁট সুন্দর,”
“তোমার স্লোগান, তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠ আমাকে আকৃষ্ট করে।”
আমি তুষারকে এই ধরনের আলাপে সব সময়েই বিব্রত বোধ করেছি এবং তাকে আমাদের সম্পর্ক সাংগঠনিক ও ফর্মাল রাখতে অনুরোধ রেখেছি।
যেহেতু বাংলাদেশের নতুন রাজনীতি, এনসিপি আমার জীবনের প্রধান অবলম্বন, আমি তুষারকে তার আগ্রাসী আচরণ সংযত রেখে, ফর্মালভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখি। বাংলাদেশের অসংখ্য নারীকে ক্ষমতাবান পুরুষের সাথে এই ধরনের সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে হয়।
ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখে এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি। রোজার সময় একদিন তুষার আমাকে অত্যন্ত আপত্তিকর একটি কথা বলে।
ইতিপূর্বে সকল আলাপের সীমা ছাড়ানো এই আলাপে আমি বিব্রত বোধ করি এবং ওকে জানাই যে আমি আর কথা বলতে চাই না। কিন্তু তুষার আমাকে আলাপের জন্য বিভিন্নভাবে চাপ দিতে থাকে।
এক পর্যায়ে তুষার আমাকে জানায় ডিটেকটিভ পুলিশ বা ডিবি ওর সাথে কথা বলেছে, সেই বিষয়ে সে আমার সাথে আলাপ করতে চায়।
যেহেতু আমি তখন উপদেষ্টা হাসান আরিফের মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত আসামি এবং তুষার আমাকে ডিবির কথা বলেছে, তাই আমার কাছে মনে হয়েছে বিষয়টি নিশ্চয়ই আইনি, ডিবি ও পুলিশসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ আলাপ হতে পারে এবং আমার নিরাপত্তার জন্য হুমকির কোনো বিষয় থাকতে পারে—এই বিবেচনায় আমি আলাপটি রেকর্ড করি।
প্রায় দেড় ঘণ্টার আলাপে ৪৭ মিনিট আমি রেকর্ড রাখি।
তুষার আমাকে জানায়, ডিবি তাকে নীলা ইস্রাফিল সম্পর্কে জানতে চেয়েছে এবং সে ডিবিকে জানিয়েছে যে নীলা তার গার্লফ্রেন্ড—যা নিয়ে আমি তুষারকে প্রশ্ন করি।
তাছাড়া আমরা তুষারের খারাপ প্রস্তাব নিয়েও আলাপ করি।
আমি তাকে প্রশ্ন করি, আমার কোনো অ্যাটিটিউড, ব্যবহার বা আচরণে মনে হয়েছে আমাকে এই ধরনের প্রস্তাব করা যেতে পারে?
তুষার আমাকে বিষয়টি ভুলে যেতে বলে।
কিন্তু তুষারের খারাপ প্রস্তাব ও তুষারের সাথে ডিবির যোগাযোগের বিষয়টি আমি মানবাধিকার কর্মী রেজাউল করিম লেনিন ও তুষারের এক্স-গার্লফ্রেন্ড বিথি সপ্তর্ষিকে জানাই। আমার নিরাপত্তা ও ডিবির প্রসঙ্গ থাকায় নিজের নিরাপত্তার জন্য আমি তুষারের সাথে আলাপের অডিওটি সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়েরকেও শেয়ার করি। আমার নিরাপত্তা হুমকি ও আমার পরিস্থিতি বিবেচনা করে প্রয়োজন পরলে প্রকাশের অনুমতি দিয়ে রাখি।
আমি প্রচণ্ড আহত হলেও, কাছের বন্ধুদের জানালেও তুষারের আপত্তিকর আলাপের বিষয়টি নিয়ে উচ্চকিত হইনি, বরং সাংগঠনিকভাবে গোপনীয়তার সাথে বিষয়টি ডিল করার চেষ্টা করি।
কিন্তু তুষার আমাকে সেই সুযোগ দেয় নাই। বিষয়টি আমার প্রফেশনাল লাইফে প্রভাব ফেলে।
সে আমার সহযোগীদেরকে বলা শুরু করে, “নীলার থেকে দূরে থাকতে হবে।”
সে আমাকে এনসিপি থেকে দূরে রাখতে, আমাকে বিভিন্ন সেল থেকে দূরে রাখতে, সাংস্কৃতিক সেল, নারী উইং, মহানগর কমিটি থেকে দূরে রাখার জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাব খাটাতে থাকে।
কোরবানির দিন রাতে একটি অনুষ্ঠানে নাহিদের সাথে দেখা হয় এবং নাহিদকে বিষয়টি জানাই।
নাহিদ আমাকে বিষয়টি দলীয় শৃঙ্খলার দিক থেকে ডিল করতে ও মহানগরে দায়িত্বে থাকা শাহরিয়ার ও নিজামকে বিষয়টি অবগত করতে বলে।
যে দিন সন্ধ্যায় শাহরিয়ার ও নিজামকে আমি জানাই, তার পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জানতে পারি যে, অডিওটি কেটে সামাজিক মিডিয়ায় প্রকাশ করা হয়েছে এবং ভাইরাল হয়েছে।
এরপর আমাকে নিয়ে যে মিডিয়া ট্রায়াল হয়, তাতে আমি দেখতে পেয়েছি, আমার নারী সহকর্মীরাও আমার পক্ষে দাঁড়ায় নাই।
আমার অপরাধ আমি পাশ্চাত্য কাপড় পরি। আমি ‘তুমি’ করে কথা বলি, সহজভাবে সবার সাথে মিশি।
আমাকে নিয়ে যে মিডিয়া ট্রায়াল হচ্ছে, সেটা আমি সহ্য করব।
আল্লাহ আমাকে এর চেয়ে অনেক কঠিন সময় দিয়েছেন।
কিন্তু আমার সহকর্মীরা বুঝতে পারছেন না, তুষার যদি আমার মতো একজন সাহসী নারীকে এইভাবে যৌন নিপীড়ন ও সাংগঠনিক প্রভাব খাটিয়ে দমন করার সুযোগ পায়, তবে আগামী দিনে তারাও নিরাপদ থাকবে না।
তাদেরকে আমার চেয়ে কঠিন নিপীড়নের শিকার হতে হবে।
সবাই নীলা ইসরাফিল নয়—
যাকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির না করে ৩৫ সপ্তাহে প্রেগ্নেনসি ৩৭ দিন কারাগারে রেখে বাচ্চার হওয়ার পর শর্ত সাপেক্ষে জামিন দেওয়ার পররেও শ্বশুরবাড়ির সামনে প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে, রাস্তায় গিয়ে প্রতিবাদ করবে, বাংলাদেশের পুরো বিচার বিভাগের বিরুদ্ধে একলা লড়বে।
আমার খারাপ লাগে এনসিপির জন্য।
আমি এনসিপিকে ভালোবাসি।
আমি ছেলে-মেয়েগুলোকে দেখেছি, তাদের শত ত্রুটি থাকতে পারে, কিন্তু তারা প্রকৃতই দেশকে ভালোবাসে।
আমার কারণে এনসিপি আজ কলঙ্কিত হলো, তাদের ট্রায়ালে পড়তে হলো।
কিন্তু আমাকে আল্লাহ অন্যায়ের মুখে চুপ করে থাকার শক্তি দেননি।
আমি তুষারের কোনো ক্ষতিও চাইনি।
আমি পার্টির ভেতরে বিষয়টা মীমাংসার চেষ্টা করেছি, চেয়েছি তুষার একটা ইন্টারনাল শাস্তি পেয়ে শুদ্ধ হোক।
আমার মতো আর কোনো নারী যেন পার্টির ভেতরে তুষার বা তুষারের মতো কারও লালসার শিকার না হয়।
এনসিপি ভদ্রলোকদের দল—এখানে যেন ভদ্র নারীরা নিরাপদে বিচরণ করতে পারে।
অনেকে বলেছেন, আপনি দ্বিতীয় ভিডিওটা কেন করলেন?
কিন্তু আমার অডিও প্রকাশের পর আমাকে যা ফেস করতে হয়েছে—
আমি সিডিওস করেছি, আমি কেন ‘তুমি’ করে কথা বলি, নিশ্চয়ই আমি পদ-পদবির লোভে ঢলে ঢলে মিশে, তারপর পদ-পদবি না পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে এই সব প্রকাশ করেছি— এই সব অভিযোগের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
কেউ আমাকে বিশ্বাস করেনি।
আমার সহকর্মীদের কেউ আমাকে ফোন করে একটু সহানুভূতি জানায়নি, যেন আমি অপরাধী আর তুষার ভিকটিম।
বিথি তার ইস্যু এখনো ডিল করতে পারেনি, তাই আমি সচেতনভাবেই রেকর্ড করেছি; যিনি প্রতিদিন গাইড করেন, তিনি যদি সেই দিন দেশে থাকতেন, হয়তো আমি এই অডিওটা বা তার পরের অডিও প্রশ্ন-উত্তরটা প্রকাশ করার অনুমতি দিতাম না। হয়তো ভুল করেছি। হয়তো ভুল করিনি।
আমার তাসনুভার জন্য খারাপ লাগছে। ওর কোনো অপরাধ নেই। আমার কারণে তাকে একটা ঘৃণ্য সময় পার করতে হলো।
এই ছাড়া আমার কোনো গিল্টি ফিলিং বা কোনো রিগ্রেট নাই।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, প্রাক্তন স্বামী, হাসান আরিফ বা তুষারের সাথে আমার প্রতিটা ঘটনা যদি রেকর্ড করে সবার সামনে ফাঁস করা হতো, তাহলে আপনারা দেখতে পেতেন—
আমি জ্বলন্ত আগুনের উপর দিয়ে হেঁটে আসা চরিত্র আর সতীত্বের পরীক্ষায় পাশ করে আসা একজন নারী।
আপনাদের পরীক্ষায় পাশ ফেল করা না করায় আমার কিছুই যায় আসে না।
এই বিষয়ে এইটা আমার ফাইনাল বক্তব্য। আমি এই নিয়ে আর কোনো কথা বলতে চাইনা। বাকি যা বলার আমি তদন্ত কমিটিকে বলবো।
আমি এই ঘটনাটি পেরিয়ে এগিয়ে যেতে চাই।’
অপরদিকে সারোয়ার তুষার লিখেন, ‘যেকোনো ঘটনায় জড়িত সংশ্লিষ্ট উভয়পক্ষ যদি একই ধরনের ইন্টিগ্রিটি না দেখায়, তাহলে ঘটনার ফেয়ারনেস নষ্ট হয়। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই, ঢাকার এলিট বাবলগুলোতে যারা মানবাধিকার, জাস্টিস ইত্যাদি নিয়ে প্রচণ্ড উচ্চকিত থাকেন, তারা খেয়াল করেন না কীভাবে তারা জাস্টিস অর্জন করতে গিয়ে নতুন করে ইনজাস্টিস করছেন, কীভাবে তাদের মানবাধিকার তোড়জোড়ের মধ্য দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। নিজের গোষ্ঠীকে জাস্টিফাই করতে উচিত-অনুচিত ন্যারেটিভ এস্টাবলিশ করতে যেমন তারা বদ্ধপরিকর; তদ্রুপ, নিজ গোষ্ঠীর বাইরে (যাদের ব্যাপারে তারা বৈরিভাবাপন্ন) কাউকে নাস্তানাবুদ ও ঘায়েল করতে এমনকি মিথ্যা প্রতিষ্ঠা করতেও তারা পিছপা হন না।
সাম্প্রতিক সময়ে আমাকে ঘিরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশ একটা হৈচৈ দেখা যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আমার চরিত্রের ব্যবচ্ছাদ করা এবং আমার সম্পর্কে রায় দেয়া সংশ্লিষ্ট সকলের ‘গণতান্ত্রিক’ অধিকার। এর আগে বছর চারেক আগে আমি একবার কাছাকাছি ধরনের ফেসবুক আদালতের তোপের মুখে পড়েছিলাম। তখন আমার সিদ্ধান্ত ছিল, যা-ই হোক না কেন, সোশ্যাল মিডিয়ার বাজারে আমি ব্যক্তিগত কেচ্ছাকাহিনি নিয়ে চর্চা করব না৷ উপযুক্ত ফোরামে নিজের লিখিত ও মৌখিক বক্তব্য জানাব। তাই করেছিলাম। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ সোশ্যাল মিডিয়া আক্রমণ তাতে থেমে থাকে নাই। আমি দীর্ঘ তিন বছর একটা প্রক্রিয়া মেনে প্রত্যেকটা পদক্ষেপ নিয়েছিলাম; অন্যদিকে আমার ব্যাপারে যা খুশি তাই মন্তব্য করা এবং আমাকে যেকোনো প্রকারে অপদস্থ করাকে অনেকেই নিজেদের “গণতান্ত্রিক সংগ্রাম”-এর অংশ বানিয়ে ফেলেছিলেন। নীরব রক্তক্ষরণ সত্ত্বেও আমি সেসব ওভারলুক করে গেছি। কেউ যদি এখনো ওই ঘটনা জানতে আগ্রহী থাকেন, ফেসবুকে আদালত না বসিয়ে let's reopen all the documents.
গত দুইদিন ধরে আবারও আমি মহামান্য ফেসবুক আদালতের ব্যাশিং এর শিকার হচ্ছি। আগের পোস্টে লিখেছি, আমি শতভাগ ত্রুটিমুক্ত মানুষ নই। কিন্তু আমার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো ঘটনাকে যখন রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের লক্ষ্যে এবং আমার দলকে ঘায়েল করার লক্ষ্যে ব্যবহার করা হয়, তখন তা আর ন্যায্য থাকে না।
পয়লা নম্বর প্রশ্ন হচ্ছে, আমার সাথে অপর এক ব্যক্তির ব্যক্তিগত ফোনালাপ ফাঁস করল কে বা কারা? এবং সেটা কীভাবে দেশের বাইরে থাকা অ্যাক্টিভিস্টদের মাধ্যমে সোশ্যাল মিডিয়ায় কাঁটছাঁট করে পরিপ্রেক্ষিতহীনভাবে ভাইরাল করা হলো? এই কাজটা কার করা?
ধরা যাক, সংশ্লিষ্ট অপর ব্যক্তির নাম “ক”। তাকে আমি চিনেছি, আপনাদের মতোই, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে। শুরুতে তার পারিবারিক কোনো ঘটনা আমার নলেজে ছিল না। জাতীয় নাগরিক কমিটির অফিসে (তখনো এনসিপি আত্মপ্রকাশ করেনি) তিনি একদিন আসেন এবং আমার সাথে সামান্য কথা হয়।
একদিন সন্ধ্যায় তিনি মাথায় গুরুতর আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে আমাদের অফিসে আসেন। তখন শীতকাল। সম্ভবত ডিসেম্বর মাস। তার ভাষ্যমতে, প্রাক্তন স্বামী তাকে ছুরি দিয়ে মাথায় আঘাত করেছেন। শুরুতে আমি অফিসে ছিলাম না। তিনি নাকি অফিসে এসে আমাকে খুঁজেছেন। এমনকি লিফটের ১৫ তলা উঠতে উঠতে আমার কথা জিজ্ঞেস করেছেন। অফিসে যারা সে সময় উপস্থিত ছিলেন, তারা তাকে প্রাথমিক শুশ্রুষা দেন। কিছুক্ষণ পর অফিসে আমি আসি। এবং যার পরামর্শ ছাড়া তিনি কোনো কাজ করেন না বলে ফেসবুকে জানিয়েছেন, সেই মানবাধিকার লেনিন ভাইও আসেন। জানাক থেকে পুলিশে খবর দেয়া হয়। পুলিশ আসলে পুলিশি প্রটোকলে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই।
সাথে আমাদের কমিটির আরও একজন পুরুষ ও নারী কর্মীও ছিলেন। গভীর রাত পর্যন্ত তাকে দুইটা হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে তারপর পুলিশ প্রটোকলসহই আমরা তাকে ধানমন্ডির এক বাসায় পৌঁছে দেই। আমরা তাকে মামলা করতে পরামর্শ দেই, তিনি জানান তিনি মামলা করবেন না। যাক, সেটা তার ব্যাপার।
ওই রাতেই আহত অবস্থায় এবং পরে আরেকদিন দেখা হলে তিনি আমাকে বলেন, তিনি চান আমরা তার প্রাক্তন স্বামীকে ‘উচিত শিক্ষা’ দেব।
খেয়াল করবেন, “ক” তার সর্বশেষ পোস্টে এই ঘটনাটার কথা উল্লেখ করেছেন ঠিকই; কিন্তু আমি ও জানাক যে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তাকে পুলিশ প্রটোকল দিয়ে নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছিলাম, এই তথ্যটা তিনি বেমালুম চেপে গেছেন। মানবাধিকার লেনিন ভাই, শহিদুল আলম, সারা হোসেন সবার নামই আছে। কিন্তু ওই রাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী সারোয়ার তুষার ও মুশফিকুর জোহানের নাম নাই। বেশ!
শহিদুল আলম ও সারা হোসেন তার জন্য ওই দিন কি করেছেন আমার জানা নাই। “তিনি চান আমরা তার প্রাক্তন স্বামীকে উচিত শিক্ষা দেব” — তার এ কথার প্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম, আপনি শহিদুল আলম, রেহনুমা, সায়দিয়া গুলরুখ তাদেরকে ঘটনাটা জানান। উনারা এসব ক্ষেত্রে বেশ হেল্পফুল। তখন “ক” আমাকে বলেছিলেন, তিনি সবার দুয়ারে দুয়ারে গিয়েছেন, সবাই তার কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন।
তার কোন কথা সত্য বা মিথ্যা আমার জানা নাই, কিন্তু তিনি এটাই বলেছিলেন।
যাই হোক, সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টে তিনি অনেকগুলো মিথ্যাচার করেছেন। ভুল ও বিকৃত তথ্য দিয়েছেন। তিনি এনসিপির কোনো পর্যায়েরই কোনো “নেত্রী” নন। কেন্দ্রীয় বা মহানগর পর্যায়ে তিনি কোনো পদ হোল্ড করেন না। এমনকি তিনি এনসিপির সদস্যও নন। কাজেই তার সাথে আমার কোনো কথাবার্তা বা এক্সচেঞ্জের সাথে কোনো “সাংগঠনিক সম্পর্ক” নাই; সাংগঠনিক ক্ষমতা-সম্পর্কের কোনো হায়ারার্কিও নাই। এটা তিনিও জানেন। কিন্তু এখন গল্প সাজাতে গেলে যেভাবে বললে কাজ হবে, তিনি সেভাবে লিখেছেন বা তাকে সেভাবে লিখে দেয়া হয়েছে।
তার কিছু বক্তব্য খেয়াল করা যাক:
“মানবাধিকারকর্মী লেনিন ভাই আমাকে নেপাল পাঠিয়ে দেয়…”
“ফেব্রুয়ারির ২৮ তারিখ এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন আমি বাংলাদেশে ফিরে আসি…”
“নেপালে যাওয়ার পর থেকে তুষার প্রায়ই আমাকে ফোন করত ও তার আলাপের ধরন পাল্টাতে থাকে…”
আমি তাকে প্রায়ই ফোন করতাম কি করতাম না সেটা পরের আলাপ। উল্লিখিত তিন উদ্ধৃতি থেকে কী দেখা যাচ্ছে? তাকে মানবাধিকার ভাইজান নেপাল পাঠিয়ে দেন। কবে? এনসিপি আত্মপ্রকাশের পূর্বে। এনসিপির আত্মপ্রকাশের দিন তিনি দেশে এসেছেন। তার ভাষ্যমতে, তাকে আমি “প্রায়ই ফোন করতাম” তার নেপালে থাকা অবস্থায়।
তখন তো এনসিপির আত্মপ্রকাশই ঘটে নাই। তাহলে “তাকে আমাদের সম্পর্ক সাংগঠনিক ও ফর্মাল রাখতে অনুরোধ রেখেছি….’’ এনসিপিই যখন গঠিত হয় নাই, তখন সম্পর্ক “সাংগঠনিক ও ফর্মাল” রাখতে বলার মানে কী?
এনসিপি আত্মপ্রকাশ করে রমজানের ঠিক আগের দিন। এরপর পুরো রমজান মাসে এনসিপির কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম ছিল না। কে কোথায় কাজ করবে না করবে সে ব্যাপারেও কোনো সিদ্ধান্ত তখনো আসেনি। ফলে আমার জানার কথা নয় “ক” এনসিপির কোথায় কাজ করতে চান। বা আদৌ চান কি না। ওই সময়ে আমি এনসিপির ২১৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটির সবাইকেই ঠিকমতো চিনে উঠে পারি নাই।
এ কথা বলার মানে হলো, রমজানের আগে, এমনকি রমজান মাসে তার সাথে আমার যতটুকুই যোগাযোগ হয়েছে, তা সাংগঠনিক দায়রা বা আওতার মধ্যে ঘটে নাই। ফলে তার সাথে আমার “সাংগঠনিক সম্পর্ক” দেখিয়ে ক্ষমতার যে হায়ারার্কি প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা অমূলক।
এবার আসি ফাঁসকৃত ভাইরাল অডিও সম্পর্কে। প্রথম অডিওতে, ওই বিশেষ শব্দটি আপনারা তার মুখেই শুনেছেন। আমি শুধু ব্যাখ্যা দিয়েছি মাত্র। “না, না, ওই এক মুহূর্তে কথা দিয়ে আমাকে জাজ করো না, প্লিজ” — এরকম ছিল আমার বক্তব্য। আসলে তিনিই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে শব্দটির কাছে আমাকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কেন? সন্দেহ করার যথেষ্ট অবকাশ থাকে যে, তিনি যেহেতু কল রেকর্ড করার উদ্দেশ্যেই কলটি করেছেন, কাজেই কথাবার্তাকে একটা সুনির্দিষ্ট দিকে তিনিই নিয়ে গেছেন। এবং এটা ঘটেছে সম্পূর্ণ আমার অগোচরে। অর্থাৎ, আমি কথা বলেছি with good faith; অন্যদিকে, তিনি কথা বলেছেন, কল রেকর্ড করে তা অন্যের হাতে তুলে দেয়ার মতলবে।
খেয়াল করার মতো বিষয়, ওই অডিও কলটির পরিপ্রেক্ষিত আমলে না নিলে চলে না। তিনি আরও একটি চ্যাট স্ক্রিনশট অন্যদের কাছে চালান করেছেন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, আমাদের মধ্যে ৩২ মিনিটের একটি ভিডিও কল হয়েছে। সেই ভিডিও কলের প্রসঙ্গ সম্পূর্ণ ইগ্নোর করে পরবর্তী ৪৭ মিনিটের অডিও কল সম্পর্কে কি কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়? নিতান্তই ব্যক্তিগত স্পেসে ধারাবাহিক আলাপচারিতায় করা একটি প্রস্তাব এখন পাবলিক স্পেসে আসায় ‘অশোভন’ মনে হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু ওই প্রশ্ন পর্যন্ত যাওয়ার একটি পরম্পরা আছে। ভিডিও কল>চ্যাটিং>অডিও কল।
এই সিকোয়েন্স মার্ক করতে হবে।
এমন কথা আমি না বললেই ভালো করতাম। আমার আরও সংযত হতে হবে। কিন্তু এখন আমার এই চরম চরিত্র হননের মুহূর্তে না বলে পারছি না, নারী-পুরুষ সম্পর্কে ক্ষমতার প্রশ্নটি এত সরল নয়। সম্মতি (কনসেন্ট; যা পুরুষ নারী কর্তৃক আদায় করে নেয় বলে অনুমান) ও বলপ্রয়োগ (কোয়ের্শন; যা নারীর অসম্মতিতে পুরুষ কর্তৃক প্রযুক্ত হয় বলে অনুমান) — এই দুই বাইনারির বাইরেও সিডাকশন তথা ফুসলানোর ক্ষমতাও যে এক ধরনের ক্ষমতা, নৃবিজ্ঞানী তালাল আসাদ সূত্রে এ কথা আমাদের অজানা নয়। অর্থাৎ, এই কনভার্সেশনের ক্ষেত্রে পরিপ্রেক্ষিত তথা উভয়পক্ষের যোগাযোগের ধারাবাহিকতা, ফুসলানো ইত্যাদিকে আমলে না নিলে ঘটনার সার্বিকতায় পৌঁছানো যায় না।
“ক”-র সর্বশেষ ফেসবুক পোস্টের কনশাস-আনকশাস মিলিয়ে যা ধরা পড়ে, যে সকল নাম তিনি নিয়েছেন, তাতেই তার নিয়ত অনেকটা খোলাসা হয়। আমার সাথে তার কথাবার্তার ব্যাপারে নাকি তিনি আমার এক্স-গার্লফ্রেন্ডকে জানান। আমার এক্স-গার্লফ্রেন্ড কি আমার বিচারক নাকি আদালত? তাকে কেন জানাতে হবে? কারণ কি এই যে, তিনি আমার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রায় নিয়মিতভাবে আদালত বসান? তারপর কি তার সাথে ফন্দি করেই আপনি কল রেকর্ড করেছেন এবং দেশের বাইরের অ্যাক্টিভিস্টদের কাছে পাচার করেছেন? প্রশ্ন ওঠাটা স্বাভাবিক।
রোজা ও রোজার আগের ঘটনা তিনি নাকি ‘সাংগঠনিক গোপনীয়তা রক্ষা করে’ মীমাংসা করতে চেয়েছেন। কী কী পদক্ষেপ তিনি নিয়েছেন এই আড়াই মাসে? সংগঠনে কোনো লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন? কাউকে মৌখিকভাবে জানিয়েছেন? জানান নাই।
রোজার প্রায় তিন মাস পর, আমার বিরুদ্ধে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রায়ালের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে, কোরবানি ঈদের রাতে এক সামাজিক দাওয়াতের প্রোগ্রামে এসে “ক” এনসিপির আহবায়ক নাহিদ ইসলামকে মৌখিকভাবে আমার বিরুদ্ধে নালিশ করেন। সেটা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনার মতো কোনো পরিবেশ ছিল না। তবু জনাব আহবায়ক “ক”-কে ভালো করে না চেনা সত্ত্বেও বলেন, শৃঙ্খলা কমিটি ও মহানগরের দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই নেতাকে যেন জানান। ইতিমধ্যেই কয়েকদিন পর কল রেকর্ড ফাঁস করার পর তিনি সামান্তা শারমিনকে দেখা হলে একই কথা জানান। সেখানে সামান্তা তাকে “মাহরাম” জাতীয় কিছু বলেন নাই, অথচ এই মিথ্যা প্রচারণাটাই চালানো হচ্ছে।
কয়েকটা ব্যাপার পরিস্কার থাকা জরুরি:
“ক” এনসিপির কোনো পর্যায়েরই কোনো “নেত্রী” বা “কর্মী” নন। তার সাথে আমার কোনো ধরনের সাংগঠনিক ক্ষমতা-সম্পর্ক বিরাজ করে না। “তাকে দূরে রাখেন”... মহানগর বা সেলের কাউকে আমি এ ধরনের কোনো নির্দেশনা দেই নাই। আসলে সেই এখতিয়ারই আমার নাই। তার এই দাবির সত্যতা কী? কে তাকে বলেছে আমি এমন নির্দেশনা দিয়েছি?
মহানগর বা কেন্দ্রীয় সেলে কাকে নেয়া হবে বা না হবে সেটা একান্তই ওই সকল কমিটি ও সেলের সিদ্ধান্ত। আমি এমনকি ঠিকমতো জানি না মহানগরের কোন কমিটি ও সেলের কোন দায়িত্ব কে দেখভালো করছে। পার্টিতে আমার কাজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি তা পালন করতেই এত ব্যস্ত থাকি যে, কমিটি ও সেল নিয়ে মাথা ঘামানো বা প্রভাবিত করার সময় বা সুযোগ কোনোটাই আমার নাই। কেন্দ্রের বাইরে এনসিপির কোনো সেল নাই। সেলে অন্তর্ভুক্ত হতে হলে অবশ্যই কেন্দ্রীয় সদস্য হতে হবে। “ক” এনসিপির কেন্দ্রের সদস্য পর্যন্ত নন। তাহলে তাকে সেলে না নেয়ার ক্ষেত্রে আমি কীভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারি? সেলে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা তথা কেন্দ্রীয় সদস্য পদই তো তার নাই! মহানগরের কমিটি যারা দেখেছেন, তাদেরকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে কাকে অন্তর্ভুক্ত করবে না করবে। এ ব্যাপারেও আমি হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার বা ক্ষমতা রাখি না। দুটি ব্যাপার খেয়াল করতে হবে:
এক, তিনি আমাকে কোনো ‘বিশেষ সুবিধা’ দিলেও তিনি যে দলে ঢুকতে পারবেন, এর কোনো নিশ্চয়তা নাই। কারণ দলের কেন্দ্রীয়, মহানগর বা অন্য কোনো পর্যায়ের কোনো কমিটিতে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা না করার সাথে আমি জড়িত নই। কাজেই যেমনটি প্রচার করা হচ্ছে, আমাকে “বিশেষ সুবিধা” না দেয়ার কারণে তিনি এনসিপিতে আসতে পারছেন না, এই দাবি ভিত্তিহীন।
দুই, আমাকে ‘বিশেষ সুবিধা’ না দিলেও দল যদি তাকে কোনো স্তরে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়, আমি সেখানে বাধাগ্রস্ত করার অধিকার সংরক্ষণ করি না। ওই একই কারণে: “কারণ দলের কেন্দ্রীয়, মহানগর বা অন্য কোনো পর্যায়ের কোনো কমিটিতে কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা না করার সাথে আমি জড়িত নই।” এটা সম্পূর্ণতই আমার কাজের সীমানার বাইরের ব্যাপার।
কাজেই এনসিপিতে তিনি আসতে পারছেন কি পারছেন না এ ক্ষেত্রে আমার করণীয় বিশেষ নাই। তবে এনসিপির বিভিন্ন ঘোষিত পাবলিক কর্মসূচিতে তাকে অংশ নিতে দেখেছি। সেখানে তাকে বারণ করা বা উৎসাহিত করার কোনো সুযোগ আমার ছিল না। এ ধরনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে এসে তিনি কখনো আমার পাঞ্জাবি টেনে ধরে বা কখনো আমার পথ আগলে আমার কাছে জানতে চেয়েছেন, তাকে দলে নেয়া হচ্ছে না কেন। যতবার তিনি আমাকে এই প্রশ্ন করেছেন, আমি একটাই উত্তর দিয়েছি: কমিটি দেয়ার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। আপনি কোনো কমিটিতে আসতে চাইলে বিষয়টা যারা দেখছেন, তাদের সাথে কথা বলুন। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ কিছু করণীয় নাই।
এক পর্যায়ে, সম্ভবত এ বছরের মে মাসের একদম শেষের দিকে অথবা জুনের শুরুতে অফিসে একদিন তার সাথে আমার দেখা হয়ে যায়। তিনি আমার সাথে কথা বলতে চাইলে আমি তার সাথে দলীয় কার্যালয়ের মিটিং কক্ষে বসি। এটাকেই অডিও কলে তিনি বলছেন, “আমি তোমাকে রুমে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছি..”
তিনি আমার কাছে জানতে চান: তাকে নেয়া হচ্ছে না কেন। আমি একই উত্তর দেই। তিনি আমাকে এক প্রকার চাপ প্রয়োগের সুরেই বলেন, চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তথা নেয়া হবে কি হবে না এটা তাকে জানাতে হবে। তিনি এ ব্যাপারে আমাকে ফোন করবেন। ম্যাসেঞ্জার চেক করে দেখলাম, তিনি ৬ জুন ম্যাসেঞ্জারে কল দিয়েছিলেন। আমি ধরিনি বা ধরতে পারিনি। বাকি ঘটনা আপনাদের চোখের সামনে।
দুইদিন আগে প্রথম যখন অডিও রেকর্ডটি ফাঁস হলো, আমি সত্যি সত্যি ভেবেছিলাম আমাকে বিতর্কিত করতে কাজটা এজেন্সি করেছে। আমি “ক”-কে জিজ্ঞেস করি, এই কল রেকর্ড ও ফাঁস কে করল? আপনারা কিন্তু দ্বিতীয় অডিও রেকর্ডে শুনতে পেলেন, তিনি বলছেন, তিনি এ ব্যাপারে কিছু জানেন না। তিনিও আমার কাছ থেকে মাত্র দেখলেন। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়েছেন! আমিও সরল মনে তার কথা বিশ্বাস করলাম। কি বোকা আমি! সাথে সাথে তাকে অনুরোধ করলাম, যেহেতু কাজটা আপনি করেন নাই, কাজেই আপনি একটা ক্ল্যারিফিকেশন দেন প্লিজ, এবং উদ্বেগ জানান এভাবে ব্যক্তিগত আলাপ কারা ফাঁস করে! আপনি যে দল করতে চান, সে দলের নেতার বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার তো আপনার ভালো লাগার কথা নয়! তিনি আমাকে বললেন, “তুমি আমাকে লিখে দাও আমি কী বলব, তবে আমি লেনিন ভাইয়ের সাথে পরামর্শ করব।”
এরপর বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করলাম, দ্বিতীয় কলটি শেষ হতে না হতেই আধঘন্টার মধ্যে সেটিও অনলাইনে চলে আসল। এবং দাবি করা হলো আমি তাকে “চাপ” প্রয়োগ করছি আমার পক্ষে স্টেটমেন্ট দিতে। অথচ নিজের হাতে আমার কলটি আরেক মোবাইল থেকে ভিডিও ধারণ করে সেটা বিদেশে পাচার করেছেন তিনি নিজেই। তারপর আবার আমি জিজ্ঞেস করার পর আবারও তিনি আকাশ থেকে পড়েছেন। তিনি নাকি কিছুই জানেন না! তার এই ডাবল গেম এবং এর পেছনে ক্রিয়াশীল পুরো সিন্ডিকেটটা সনাক্ত করতে আমার বেশ খানিকটা সময় লেগে গেছে।
এই সিন্ডিকেটের মোটিভ পরিস্কার। ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে আমার মানহানী ও চরিত্রহনন করা। সেভাবেই তাকে স্ক্রিপ্ট লিখে দেয়া হয়েছে। দুইজন ব্যক্তির কথোপকথনে যদি একজনের নিয়ত থাকে তিনি কল রেকর্ড করবেন এবং তা ফাঁস করবেন; দ্বিতীয় ব্যক্তি যদি এই পরিকল্পনার ব্যাপারে সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকেন, তাহলে যা ঘটার কথা, আমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
ঘটনাটা সোশ্যাল মিডিয়ায় কারা পিক করেছে তা খুব পরিস্কার। আওয়ামী কালচারাল উইং, ৫ আগস্টের পর থেকে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও বক্তব্যে নাখোশ বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষ এই ঘটনাকে লুফে নিয়েছে। তাদের টার্গেট স্রেফ আমি না; বলা ভালো, এনসিপিই তাদের প্রধান টার্গেট। ঈদের পর জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের আলোচনা শুরু হওয়ার ঠিক আগের রাতে আমার বিরুদ্ধে এই সংঘবদ্ধ অনলাইন মব সৃষ্টি, নিছক কাকতাল নয়। তারা খুব ভালোভাবেই অবগত আছেন, এনসিপির পক্ষে আমি জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে দলের পজিশন তুলে ধরি। গত কয়েকমাসে রাজপথের বক্তৃতায়, টকশোতে এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সংস্কার প্রশ্নে আমার অনমনীয় অবস্থান সমাজে ওয়েল এস্টাবলিশড। আমি যে টার্গেট হব, এটা আশ্চর্যের নয়। রাজনৈতিক বিরোধিতা ও না-পছন্দকে ব্যক্তিগত চরিত্রহননের মতো ঘৃণ্য কাজের মাধ্যমে মোকাবেলার মতো জঘন্য কাজ আর হয় না।
জনাবা “ক” অবশ্য তাজনূভার দুঃখে কাতর! কেন অহেতুক তাজনূভাকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই চরিত্রহনন ও যৌন আক্রমণ চলছে, তা তাকে বেশ দুঃখিত করেছে বৈকি! অথচ দুইটা দিন তিনি চুপ থাকলেন, হোয়াটসঅ্যাপে আমাকে বলতে থাকলেন, তিনি কল ফাঁসের ব্যাপারে কিছু জানেন না। এদিকে তাজনূভার সাথে এটা ঘটতে দিলেন। ওই নারীর পরিচয় জানার পরও তাজনূভাসহ এনসিপির নেতাকর্মীরা তার পরিচয় ফাঁস না করে রাজনৈতিক ভদ্রতার এক অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। তাজনূভা জাবীনও যে তার শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান ও বক্তব্যের কারণে কোনো কোনো পক্ষের চক্ষুশূল, তা বলাই বাহুল্য।
ভালো কথা, গত ১৬ মে অনুষ্ঠিত নারীদের মৈত্রীযাত্রার একটা ঘটনা শেয়ার করি। সেখানে যাওয়ার কারণে তাজনূভা বেশ আক্রমণের শিকার হয়েছিলেন। আমি তাজনূভার পক্ষে প্রতিবাদ করে ফেসবুকে কিছু কথা লিখেছিলাম। এরপরের দিন, গত ১৭ মে, জনাবা “ক”, আমাকে ম্যাসেঞ্জারে লেখেন, “তুমি আমার কথাটা উল্লেখ করতে পারতে।” অর্থাৎ, মৈত্রীযাত্রায় যাওয়ার কারণে তিনিও আক্রমণের শিকার হয়েছেন, সেটা আমি কেন উল্লেখ করলাম না এই নিয়ে তার অনুযোগ! অথচ তার ভাষ্যমতে আমি তাকে ‘কুপ্রস্তাব’ দিয়েছি গত রোজায়, মার্চ বা ফেব্রুয়ারি মাসে!
কল রেকর্ড ফাঁসের পর গত দুইদিন তিনি আমাকে হোয়াটসঅ্যাপে নানা কথা বলেছেন। যার সারমর্ম হচ্ছে তিনি এটা “দলের ভেতরেই মিটমাট” করতে চেয়েছেন, আমি নাকি সেই সেই সুযোগ রাখি নাই। কীভাবে? আমাকে চরমভাবে অপদস্থ করার পর কেউ কেউ যখন তাকে সনাক্ত করতে পেরেছেন, তার বিরুদ্ধেও কেউ কেউ কিছু কথা বলেছেন। এগুলো নাকি আমি করিয়েছি! তিনি আর এসব ‘বাড়াতে চান না’।
বাহ! একদিকে আমাকে অনলাইন নাৎসিদের হাতে তুলে দিয়ে চরমভাবে অপদস্থ ও চরিত্রহননের পর তিনি আর ‘বাড়াতে চান না’। আমি তাকে বলেছি, সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ধরনের ঘটনা ব্রেক হওয়ার পর, সেসব আর কারো নিয়ন্ত্রণে থাকে না। পক্ষে-বিপক্ষে কথা ছড়ায়। এখানে আমার কোনো হাত নাই। আমার বিরুদ্ধে নজিরবিহীন মব সৃষ্টি করার পর আমার বিরুদ্ধে তার অভিযোগ, “তুমি মব সৃষ্টি করছো।”
গত দুইদিন আমি এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে আছি। আমার নামে বিভিন্ন ফেইক স্ক্রিনশট ভাইরাল করা হয়েছে, আমার ছবি বিভিন্ন পর্নো সাইটে তুলে দিয়ে সেসব distorted & edited ছবির স্ক্রিনশট আবার ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। আমার আর তাজনূভার ছবি জুড়ে দিয়ে জঘন্য অশ্লীল ও যৌনাত্মক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এতে করে আমার সামাজিক মর্যাদা, রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং আমার দলের ইমেজ ভূলন্ঠিত। দেখা যাচ্ছে যে, আমার ব্যক্তিগত ও মানবিক মর্যাদা এভাবে ধূলিসাৎ করাটাও অনেকের কাছে ন্যায়ের পরাকাষ্ঠা!
এসবের পরিবেশ তৈরি করেও নাকি ভদ্রমহিলা এই দলকে ‘বিতর্কিত’ করতে চান না, তিনি এই দলের ‘ভালো’ চান, তিনি সব ‘মিটমাট’ করতে চান! তথাস্তু!
যেভাবে এই ঘটনায় জনাব নাহিদ ইসলাম, সামান্তা শারমিন, তাজনূভা জাবীন ও দলের অন্যান্য নারীদের টেনে আনা হয়েছে, তাতে খুবই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে এনসিপিই টার্গেট। এনসিপির ইমেজ ডাউন করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটাই এই পুরো ঘটনাপ্রবাহের মূলে। আমার দল যখন নিবন্ধনের জন্য আবেদন জমা দিতে চরম ব্যস্ত সময় পার করছে, ঐকমত্য কমিশনে রাষ্ট্র সংস্কার প্রশ্নে সবচেয়ে ডিসাইসিভ ও বোল্ড পজিশন নিয়েছে, তখনই এই সংঘবদ্ধ আক্রমণ ঘটানো হলো।
নতুন দল হিসেবে এনসিপি এক মিডিয়া ক্রুসেডের মুখোমুখি। প্রতিদিনই এনসিপির বিরুদ্ধে চরম আপত্তিকর ও ভুলভাল তথ্য অনলাইনে ছাড়া হচ্ছে। সামনে এটা আরও বাড়বে। ইনশাআল্লাহ, এনসিপি এসব মোকাবেলায় প্রস্তুত আছে।
আমি দলের কাছে লিখিত জবাব দেব। আমার জবাব অবশ্য আমি নিজেই লিখি, অন্য কাউকে লিখে দিতে হয় না।
সংশ্লিষ্ট অপর নারী নিজ প্রোফাইল থেকে আমার বিরুদ্ধে পোস্ট দিলেও, এখানে আমি তার নাম নিলাম না। এজন্য চড়া মাশুল দিতে হলেও এটা আমার মডেস্টি আর ইন্টিগ্রিটির একটা স্মারক হয়ে থাক। ব্যক্তিগত যৌন-কেচ্ছার জায়গা অনলাইন পরিসর নয়। যারা সংশ্লিষ্ট নারীকে চিনেছেন, তাদের কাছে আমার আহবান, তার ব্যাপারে কোনো কুরুচিপূর্ণ ও আপত্তিকর মন্তব্য করবেন না। এহেন কুৎসা সোশ্যাল মিডিয়ায় চর্চা না হওয়াই কাম্য।
আমি এক ঘৃণ্য রাজনৈতিক চক্রান্তের শিকার। Still I believe only truth shall prevail.’