নির্বাচন নিয়ে জামায়াত কি নিজেদের অবস্থান পাল্টাচ্ছে?

অনলাইন ডেস্ক
প্রকাশ: ১১ জুলাই ২০২৫, ১২:৩৬

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে জামায়াত আমির। ছবি: সংগৃহীত
রাজনীতিতে হঠাৎই উত্তাপ। ইস্যু নির্বাচন। রোজার আগেই নির্বাচন হতে পারে এমন আভাস দেওয়া হচ্ছে সরকার থেকে। অন্তত প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং সেটাই বলছে।
একইসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে ভোটের প্রস্তুতি নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। বিশেষত, আইনশৃঙ্খলা বিষয়ক প্রস্তুতি ডিসেম্বরের মধ্যেই নিতে বলেছেন তিনি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে যখন এমন বার্তা আসছে, তখন নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলছে রাজনৈতিক দলগুলো।
আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমান সম্প্রতি একটি জনসভায় বক্তব্য দিয়েছেন। সেখানে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম থানা থেকে বিএনপি কর্মী ও সাজাপ্রাপ্ত আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনার উল্লেখ করেন তিনি, বলেন ‘এমন অবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের কল্পনাও করা যায় না।’
অন্যদিকে, আরেকটি দল জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) এখন ব্যস্ত ঢাকার বাইরে পদযাত্রা কর্মসূচিতে। এসব কর্মসূচিতে দলটির নেতারা একাধিকবার বলেছেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ও মৌলিক সংস্কার ছাড়া তারা নির্বাচনে যাবেন না। ফলে নির্বাচন নিয়ে দলগুলোর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
জামায়াত কি নির্বাচন পেছাতে চায়?
বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে শুরু থেকেই সংশয় আছে। গত পাঁচই অগাস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নতুন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এর কিছুদিন পর থেকেই বিএনপি বলে আসছে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিতে।
প্রধান উপদেষ্টা যখন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছিলেন, সেখানে বিএনপি ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন চেয়ে এসেছে। তবে পরে লন্ডনে তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের প্রসঙ্গ এলে সেটায় একমত হওয়ার কথা জানিয়েছে বিএনপি।
এই পুরো সময়ে অন্য অনেক দলের মতো জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচন নিয়ে নানা কথা বলেছে। দলটি শুরুতে প্রধান উপদেষ্টার ডিসেম্বর থেকে জুনের সময়সীমাকে সাধুবাদ জানায়। বলে এই সময়সীমার যেকোনো মাসে নির্বাচন নিয়ে আপত্তি নেই জামায়াতের। তবে দলটির অবস্থান এর পরেও কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে বিভিন্ন সময়।
কখনো দলটি এই সময়সীমার মধ্যেই নির্দিষ্টভাবে এপ্রিল মাস, আবার কখনো ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের কথা বলেছে। যদিও দলটির নেতারা এসব বক্তব্যকে নির্বাচনের তারিখ নিয়ে দলের অবস্থানের পরিবর্তন হিসেবে দেখতে নারাজ।
জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেছেন, ‘আসলে অবস্থানের কোনো পরিবর্তন নেই। জামায়াত প্রথম থেকে নির্বাচনের সময় নিয়ে যে বক্তব্য দিয়ে এসেছে, সেখানে ধারাবাহিকতা আছে। আমরা বিপরীতমুখী না, বরং একইরকম বক্তব্য দিয়ে এসেছি। ডিসেম্বর থেকে জুনের কথা সমর্থন করলেও পরে আমরা বলেছি ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলে নির্বাচন হতে হবে।’
কিন্তু নির্বাচনের পরিস্থিতি নেই এমন কথা কেন বলা হচ্ছে দলটির পক্ষ থেকে? এমন প্রশ্নে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয়ের কথা বলেন তাহের।
তিনি বলেন, ‘নির্বাচন যদি এপ্রিলে করতে হয় বা ফেব্রুয়ারিতে করতে হয় তাহলে আর ছয়-সাত মাস সময় আছে। এর মধ্যে ভোটার তালিকা আপডেট হয়ে যাওয়ার দরকার ছিল। সেটা এখনো হয়নি। দ্বিতীয় হচ্ছে, এখন প্রশাসনে যে সেটিংটা আছে, অর্থাৎ ডিসি, এসপি, ইউএনও ইত্যাদি এখানে আমরা বলেছি নিরপেক্ষ লোকদের বসাতে হবে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সেটা নিশ্চিত করতে হবে বিফোর ডিক্লেয়ারিং দ্য ইলেকশন।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এটার জন্য রাজনৈতিক দল ও স্টেক হোল্ডারদের নিয়ে যে বসা দরকার ছিল, সেগুলো হচ্ছে না। প্রশাসন তো বটেই, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।’
সংস্কার নিয়ে ঐকমত্যে বাধা দেওয়ার অভিযোগ জামায়াত-এনসিপির
জামায়াত বলছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়াও মৌলিক বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কার এবং জুলাই সনদ নির্বাচনের আগেই হতে হবে। কিন্তু নির্বাচনের আগে সংস্কারে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হচ্ছে–– জামায়াত এমনটা মনে করে।
আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা বলেছি প্রয়োজনীয় সংস্কার লাগবে। কিন্তু সেখানে আমরা দেখছি কোনো কোনো দলের পক্ষ থেকে সংস্কারকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, সংস্কারের ঐকমত্যের প্রক্রিয়ায় বাধা দেয়া হচ্ছে এবং সংস্কার যেন না হয় সেরকম একটা আবহ তৈরি করছে।’
তবে সংস্কার কিংবা নির্বাচন নিয়ে শুধু জামায়াত নয়, একই সময়ে আরও শক্ত বক্তব্য এসেছে এনসিপি থেকেও। দলটি বলেছে, জুলাই ঘোষণাপত্র আর সংস্কার ছাড়া নির্বাচনেই না যাওয়ার কথা।
কিন্তু এই সময়ে এসে এই কথার উদ্দেশ্য কী? এমন প্রশ্নে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসাইন বলেন, দেশে পরিবর্তন না হলে শুধু সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য নির্বাচনে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে নির্বাচন হতে দেওয়া হবে না এমন কথা কিন্তু কেউ বলেনি। কোনো দল বলেনি। বরং সবাই বলেছে নির্বাচন হতে হবে এবং সেটা কিছু পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গিয়ে তারপর হতে হবে, মৌলিক সংস্কার বাস্তবায়ন হওয়ার পর হতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু এখানে একটা টেনশন রয়ে গেছে। মৌলিক সংস্কারের প্রশ্ন আসলেই কয়েকটি দল এর বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। পরবর্তী সরকারের হাতে সংস্কারকে ছেড়ে দেওয়ার একটা আলাপ তোলা হয়েছে। বলা হচ্ছে, এই সরকারের আসলে সংস্কার করার ম্যান্ডেট নেই। তাহলে শুধু নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা এবং নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর আকাঙ্ক্ষাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া আমাদের সম্ভব হবে না।’
জামায়াত এবং এনসিপি উভয় দলই মূলত বিএনপিসহ কয়েকটি দলকে ইঙ্গিত করেছে। এর কারণ হচ্ছে, সংস্কারের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু–– বিশেষ করে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও ক্ষমতার ভারসাম্যের প্রশ্নে বিএনপির সঙ্গেই বিরোধ তৈরি হচ্ছে এই দলগুলোর।
বিএনপি কি নির্বাচন নিয়ে সংশয় দেখছে?
নির্বাচনের পরিবেশ ও মৌলিক সংস্কার ইত্যাদি নিয়ে এনসিপি এবং জামায়াত নেতারা অনেকটা একই সুরে কথা বলছেন। আবার উভয় দলই জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের দাবিতে অটল আছে। যেটাকে আবার সমর্থন দিচ্ছে ইসলামী আন্দোলনসহ বিভিন্ন দল। তবে নির্বাচনের আগে বিএনপি মৌলিক সংস্কার বাধা দিচ্ছে–– এমন অভিযোগ নাকচ করছে দলটি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সত্তর অনুচ্ছেদ কি কোনো ঠুনকো বিষয়? আমরা রাজি হইনি? প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ কি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না? আমরাই তো এখানে দশ বছরের মেয়াদ প্রস্তাব করেছি। এরকম ধরে ধরে বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আমরা দেখাতে পারবো যেগুলোতে আমরা সংশোধনী প্রস্তাব এনেছি কিংবা একমত হয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘এখন যদি সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব বা অন্য দলের প্রস্তাবে অযৌক্তিকভাবে শতভাগ একমত হতে বলা হয়, এমনকি অযৌক্তিকভাবে যেখানে সরকারের চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স ক্ষুণ্ন হবে রাষ্ট্র পরিচালনায়, সেখানেও যদি সবাইকে নিঃশর্ত রাজি হতে বলে সেটা তো সংস্কার হলো না।’
বিএনপি তার অবস্থান স্পষ্ট করছে–– সব বিষয়ে একমত হওয়া সম্ভব নয়, যৌক্তিকও নয়। কিন্তু একে ঘিরে অন্য দলগুলোর যে বক্তব্য সেটা নিয়ে দলটির মূল্যায়ন কী?
সালাহউদ্দিন আহমদ অবশ্য মনে করছেন, এটা নির্বাচনের আগে দলগুলোর রাজনৈতিক দর কষাকষির অংশ। তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যারা...রাজনৈতিকভাবে জনপ্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে হয়তো খুবই ক্ষুদ্র অংশের প্রতিনিধি। এখন তাদের একটা বড় চাওয়া-পাওয়া থাকতেই পারে। এগুলো হয়তো সেটারই অংশ। তাদের এই রাজনৈতিক বক্তব্য মাঠে একরকম থাকলেও আলোচনার টেবিলে কিন্তু আমরা ভিন্ন বক্তব্য পাই।’