১৯৫৩ সালে ইরানের প্রধান দুই নেতা আয়াতুল্লাহ কাশানি ও মোসাদ্দেক
সমগ্র বিশ্বের এখনকার প্রধান আলোচ্য বিষয় ইরানের ভবিষ্যত। এ বিষয়ে বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার প্রতিবেদন ও মতামত প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলাদেশেও কম হচ্ছে না। আগ্রহীরা সেসব দেখছেন-পড়ছেন। এটা আর লুকোচাপা নেই, ইরান প্রধানত যুক্তরাষ্ট্রের দুশমনির শিকার।
যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে মদদ না দিলে, নির্দেশ না দিলে এবং তাতে নানানভাবে অংশ না নিয়ে আগ্রাসন এই চেহারা নিতো না।
তবে, ইরানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ-আমেরিকানদের এরকম দুশমনি কেবল সম্প্রতি শুরু হয়নি। এমনকি এটা শুধু ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পর শুরু হয়েছে তেমনও নয়। এই আগ্রাসনের শুরু এখন থেকে প্রায় ৭৫ বছর আগে— জাতীয়তাবাদী মোসাদ্দেক সরকারকে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে উৎখাতের ভেতর দিয়ে। ইতিহাসের ঐ অংশ ভালো করে না বুঝে আজকের ইরান ও তার ভবিষ্যত সম্পর্কে অনুমান করাও দুরূহ হবে।
১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান নিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে বিপুল তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যায়। এম-১৬ এবং সিআইএ যে ঐ অভ্যুত্থান ঘটায় সেটা ঐসব দেশের নানান ব্যক্তিরা বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-উপাত্তসহ অনেকভাবে স্বীকার করেছেন।
১৯৫৩ এর অভ্যুত্থান প্রথম দফা ব্যর্থ হলেও ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দ্বিতীয় অভ্যুত্থানে মোসাদ্দেক বন্দি হন। অভ্যুত্থানের আগে দেশটির বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করে জনগণকে সরকারের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলারও কাজ শুরু হয়েছিল।
খুব সংক্ষেপে বললে মোসাদ্দেক সরকারকে ফেলে দেয়া হয়েছিল জ্বালানি সম্পদের জাতীয়করণ করে তিনি ব্রিটেনসহ পশ্চিমা স্বার্থে আঘাত হেনেছিলেন। অন্যদিকে, সামাজিক অসাম্য কমাতে নানান পদক্ষেপ, বিশেষ করে ভূমি সংস্কার ইত্যাদিতে হাত দেয়ায় দেশটির রূপান্তরবাদী শক্তিসমূহ তাঁর পাশে দাঁড়ায়। মোসাদ্দেক ন্যাশনাল ফ্রন্ট নামে একটা জোটের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। যাতে আয়াতুল্লাহ তালেকানিসহ আরও কয়েকজন ধর্মীয় নেতাও ছিলেন।
এর বাইরে এসময় ইরানের মজলিসে ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে আয়াতুল্লাহ আবুল-ঘাসেম কাশানিও বেশ প্রভাবশালী নেতা। তালেকানির মতো তিনিও মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের জাতীয়করণ নীতি সমর্থন করছিলেন।
মূলত এই দুই ধারার যৌথ ভূমিকাতে তখন ইরানে পশ্চিমা তেল কোম্পানিগুলোর লুটপাট বন্ধ করা গিয়েছিল।
কিন্তু দ্রুত ব্রিটিশ-আমেরিকান অক্ষশক্তি পাল্টা আঘাত হানে। যার ফল ছিল ১৯৫৩ সালের অভ্যুত্থান।
দুর্ভাগ্যের ব্যাপার ছিল, শুরুতে মোসাদ্দেক সরকারের সমর্থক থাকলেও মজলিশের স্পিকার প্রভাবশালী আয়াতুল্লাহ আবুল-ঘাসেম কাশানি এক পর্যায়ে শাহ ও পশ্চিমাদের অভ্যুত্থানে সমর্থন দেন। ফলে পশ্চিমের অক্ষশক্তি সহজে মোসাদ্দেককে ক্ষমতাচ্যুত করে পাহলভি বংশের হাতে ক্ষমতার লাগাম তুলে দিতে সক্ষম হয়।
১৯৭৯ পর্যন্ত এভাবেই চলে।
১৯৭৯ এর রাজতন্ত্র বিরোধী বিপ্লবেও খোমেনি ও ওলামা সম্প্রদায়ের সঙ্গে ন্যাশনাল ফ্রন্ট ও বামপন্থী তুদেহ পার্টি এক সঙ্গে লড়েছে। তবে এরপরের কাহিনী সবার জানা। শেষপর্যন্ত দেশটিতে নানান অধ্যায়ের ভিতর দিয়ে ক্ষমতা খোমেনি ও তাঁর সহযোগীদের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। তালেকানির মতো প্রভাবশালী আয়াতুল্লাহও রহস্যজনকভাবে মারা যান। সেসব আলোচনার বদলে এখানে বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে ১৯৫৩ সালের ইরানের দিকে।
আজকের ইরান ১৯৫৩ সালের দুশমনদের দ্বারাই চূড়ান্ত এক আঘাতের মুখোমুখি। জানি না, ইরানীদের এখন মনে পড়ছে কি না-- ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেক-কাশানিদের জাতীয় ঐক্য থাকলে ইরানের ইতিহাস ভিন্ন হতো।
তুদেহ পার্টি কিন্তু খোমেনি অনুসারীদের দ্বারা বিপ্লবের পর ক্ষমতার পরিসর থেকে বিতাড়িত হলেও এবারও ইজরায়েল-আমেরিকা-ব্রিটেনের সম্মিলিত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও ১২ জুন তারা এ বিষয়ে পরিষ্কার বিবৃতি দিয়ে কর্মীদের জাতীয় সার্বভৌমত্বের পক্ষে দাঁড়াতে বলেছে। অতীতে তারা দেশটির বর্তমান শাসকদের হাতে নির্মমভাবে মার খেলেও প্রকৃত শত্রু চিনতে ভুল হচ্ছে না তাদের। এরকম ভুল কী ঘটাতে পারে ইরানীরা ১৯৫৩ সালে সেটা দেখেছে।
এক্ষেত্রে বার্তাটি আসলে সরল-সোজা। বিদেশী শত্রুর আগ্রাসন রুখতে হলে জাতীয় ঐক্য দরকার। আর, বিদেশী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে স্বাধীন উন্নয়ন পথ বেছে নিতে হলে জাতীয় ঐক্যে দরকার বাড়তি দৃঢ়। গত দশকগুলোতে ইরান প্রযুক্তি ও সামরিক শক্তিতে অনেক বলীয়ান হয়েছে। কিন্তু দেশটির অভ্যন্তরে জাতীয় ঐক্যের দুর্বলতা কমানোর উদ্যোগে ঘাটতি আছে। প্রতিপক্ষ ঠিক সে-ই সুযোগ নিচ্ছে। আগ্রাসন মোকাবেলায় ইরানের সক্ষমতার সংকটটা সেখানে।
৭৫ বছরের ব্যবধানে ইরানের অভিজ্ঞতা বাংলাদেশসহ এরকম সকল দেশগুলোর জনগণের বেলায় প্রযোজ্য। স্বরাজের পক্ষে জাতীয় ঐক্য থাকলে দেশের চেহারা একরকম থাকে, ঐক্যে ফাটল থাকলে অন্য অবস্থা তৈরি হয়।