Logo
Logo
×

জাতীয়

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

Icon

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ১৩ জুলাই ২০২৫, ১৮:২৩

আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিতে সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন

ছবি: সংগৃহীত

ঢাকায় মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা সরকারকে নতুন করে সমালোচনার মুখে ফেলেছে। আবারও প্রশ্ন উঠছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার এগার মাস পার হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যর্থ হচ্ছে?

কারণ মব বা দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা, বিভিন্ন স্থানে হামলা, খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। বিএনপিসহ কোনো কোনো দল সরকারের বিরুদ্ধে মবকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগও তুলেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বাংলা সংস্করণ বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে মিটফোর্ডের ঘটনা ছাড়াও খুলনায় যুবদলের এক নেতাকে হত্যার পর পায়ের রগ কেটে দেওয়া, চাঁদপুরে মসজিদের ভেতরে ইমামকে চাপাতি দিয়ে কোপানোসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, চাঁদাবাজিসহ বহু ঘটনা আলোচনায় এসেছে।

এর আগে মার্চ মাসে ঢাকার কাছে মাদারীপুর জেলার সদর উপজেলায় আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে মসজিদের ভেতরে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিলো।

এর মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে একের পর এক ‘মব সন্ত্রাস’ জনজীবনে আরেক উপসর্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, যেসব ঘটনার সময় অনেকে ক্ষেত্রেই সরকার কিংবা পুলিশ দেখেও কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে।

ফলে পরিস্থিতির ক্রমাবনতির জন্য ‘সরকারের সদিচ্ছা’ কতটা আছে সেই প্রশ্নও উঠেছে বিভিন্ন সময়ে। এমনকি নির্বাচন বিলম্বিত করতে প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রাখার অভিযোগ করা হয়েছে বিএনপির একটি অংশের পক্ষ থেকে।

মিটফোর্ড হত্যাকাণ্ডের পর কোনো কোনো পক্ষ বিএনপিকে দায়ী করে মিছিল করার পর দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘মব’ (দলবদ্ধ সহিংসতা) সৃষ্টি করে একটি পরিস্থিতি তৈরির চেষ্টার পেছনে সরকারের কোনো প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় আছে কি না, সে প্রশ্ন তুলেছেন।

বিশ্লেষকরা বলছেন, পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকারের আগ্রহটাই তাদের পদক্ষেপে প্রকাশ পায়নি বলেই পরিস্থিতি এই পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। তাদের মতে, শুরু থেকে শৈথিল্য দেখিয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলে এখন মব সন্ত্রাস, খুন, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে গেছে।

ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী আজ রবিবার (১৩ জুলাই) সচিবালয়ে জানিয়েছেন, দেশে খুন, চুরি, ডাকাতি, চাঁদাবাজি, নারী নির্যাতন, সন্ত্রাস, মাদক চোরাচালানসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। আজ থেকেই এজন্য ‘চিরুনি অভিযান’ শুরু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

গত ছয় মাসের পরিস্থিতি

আইনশৃঙ্খলার ক্ষেত্রে গত কয়েক মাসের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা হলো মব বা দলবদ্ধ সন্ত্রাস। প্রকাশ্য দিবালোকে কখনো কখনো সামাজিক মাধ্যমে পূর্বঘোষণা দিয়ে মব হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা।

দেশটির মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে, গত ছয় মাসে অন্তত ১৪১টি মবের ঘটনায় ৮৩ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় ভয়াবহভাবে খুনের ঘটনাটির আগে মাদারীপুরে মসজিদে আপন দুই ভাইসহ তিনজনকে হত্যার ঘটনা দেশজুড়ে আলোড়ন তুলেছিলো।

মূলত চলতি বছরের শুরু থেকেই বিভিন্ন এলাকায় প্রকাশ্যে হত্যা, ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনায় উদ্বেগ তৈরি হয়েছিলো। এক পর্যায়ে 'অপারেশন ডেভিল হান্ট' নামে অভিযান শুরু করলেও তা কতটা কাজে লেগেছে সেই প্রশ্নও আছে।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসেবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩৩০টি, যার মধ্যে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ছিলো ৬৬টি। এর মধ্যে বাইশটি হলো ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনা।

এই সময়ে গণপিটুনিতে ৮৯ জন নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ঢাকাতেই মারা গেছে ৪৫ জন।

এছাড়া এই সময়ে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ৪৪ জন। এসব সহিংসতার মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ সহিংসতার ১৩১টি ঘটনায় মারা গেছে ২৬ জন আর আহত হয়েছে ১৪৭৭ জন।অন্যদিকে এই সময়কালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নিরাপত্তা হেফাজতে প্রাণ হারিয়েছে ১৫ জন।

হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি নামের একটি সংগঠন সংবাদ মাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বলেছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসের রাজনৈতিক সহিংসতায় মৃত্যু, গণপিটুনিতে নির্যাতন ও হত্যা, নারী নিপীড়ন ও ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন ও সাংবাদিকদের ওপর হামলা বৃদ্ধি পেয়েছে।

তাদের হিসাবে, বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে ও নির্যাতনে মৃত্যু, শ্রমিকদের ওপর হামলা, সংখ্যালঘু নির্যাতন, মাজারে হামলা ও ভাঙচুর, কারাগারে মৃত্যু, সভা-সমাবেশে বাধা প্রদান, আন্দোলনরত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ওপর পুলিশের হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে।

সংস্থাটি বলছে, এ সময় চাঁদাবাজি, চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি ও হত্যাসহ বেশ কিছু সামাজিক অপরাধ ঘটেছে যা জনমনে ভয় ও আতঙ্ক তৈরি করেছে।

সরকার পারছে না কেন?

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ বাহিনী পুনর্গঠনে দীর্ঘ সময় নেওয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ বিরোধী আন্দোলনে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা কিছু ব্যক্তি অনলাইনে বা প্রকাশ্যে দলবদ্ধ হামলা বা সহিংসতাকে উস্কে দিলেও সরকার সেগুলোর বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করেনি- এমন অভিযোগ আছে।

বিএনপির সহযোগী সংগঠন ছাত্রদল বলেছে, ‘গোপন তৎপরতায় অভ্যস্ত একটি সংগঠন মব সৃষ্টির’ অপচেষ্টা করে আইনশৃঙ্খলার অবনতির চেষ্টা করছে। আরেক সহযোগী সংগঠন যুবদল সভাপতি আব্দুল মোনায়েম বলেছেন, নির্বাচনকে বিলম্বিত করতেই প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে সরকার।

আবার জামায়াত ও এনসিপিসহ বিভিন্ন দল সারাদেশে বিএনপির ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ কর্মী সমর্থকদেরই এমন পরিস্থিতির জন্য দায়ী করছেন। এমনকি দেশের বিভিন্ন জায়গায় তাদের মিছিল সমাবেশ থেকে দলটির নেতা তারেক রহমানের বিরুদ্ধেও শ্লোগান দেওয়া হয়েছে গত শুক্রবার (১১ জুলাই) রাতে।

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান শনিবার (১২ জুলাই) ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় বলেছেন: ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কেন বসে আছেন? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে চালায় কে? বিএনপি তো চালায় না! চালাচ্ছে তো সরকার। তাহলে সরকার কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’

দলটির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, তারা এ পর্যন্ত প্রায় চার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছেন।

তিনি বলেন, আমাদের যেটুকু করার সেটা তো আমরা করছি। সরকারের দায়িত্ব আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। আইন শৃঙ্খলা ঠিক করা।’

বিশ্লেষকরা অবশ্য বলছেন, শুরু থেকেই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার যে আগ্রহী-সেটি তাদের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পায়নি কখনো।

পুলিশের সাবেক আইজিপি এম নূরুল হুদা বলেছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে মারাত্মক শৈথিল্য দেখানো হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সুযোগ থাকা সত্ত্বেও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ফলে অনেকে মনে করেছে অন্যায় করলে কোনো সাজা পেতে হবে না। 

মানবাধিকার সংগঠক নূর খান লিটন অবশ্য বলছেন, সামাজিক দুর্বৃত্তের পাশাপাশি একটি ছোটো রাজনৈতিক গোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে চাইছে।

তিনি বলেন, মব তৈরি করে সন্ত্রাস, খুন, চাঁদাবাজি, দখল সব অব্যাহত আছে। সরকারের দিক থেকে দৃশ্যমান কঠোর পদক্ষেপ দরকার। এতে যত দেরি হবে তত সংকট ঘনীভূত হবে। 

সরকারের দিক থেকে যে পদক্ষেপ প্রত্যাশা করা হয়েছিলো তাতে ঘাটতি দেখছেন তারা।

নূর খান লিটন বলেন, ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশের নামে এগুলোর কোনো সুযোগ নেই। আবার এগুলোকে হালকা করে দেখা মানে আইনের শাসনকে কুঠারাঘাত করা।

আবার কোনো ঘটনা ঘটলেই একটি পক্ষ তাকে রাজনৈতিক রং দেওয়ার যে চেষ্টা করছে, সেটিও অনেককে অপরাধে উৎসাহিত করছে বলে মনে করেন কেউ কেউ।

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, বরং সামাজিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলোর দায়িত্ব আছে। কিন্তু তারা সেভাবে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছে না। যেভাবে ঘটনাগুলোতে রাজনৈতিক রং চড়ানো হয়- তা আসলেই দুর্ভাগ্যজনক।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী অবশ্য আজ থেকেই চিরুনি অভিযান শুরুর কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সব ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে এবং জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কার্যক্রম সরকার কঠোর হাতে দমন করবে।

এর আগে শনিবার সরকারের আরেকজন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছিলেন, মব জাস্টিস সরকার কোনোভাবেই বরদাশত করে না। এখন যেই ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

তিনি দাবি করেন, যখনই মব জাস্টিস (দলবদ্ধ সন্ত্রাস) ঘটেছে সেখানেই জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং তাদের কাউকে ছাড়া হয়নি।

Logo

অনুসরণ করুন